জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে (ইউএনজিএ) বাংলায় দেওয়া ভাষণে আগামী বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাষ্ট্রদূতদের কাছে আগামীর পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ড. ইউনূস বলেন, “এই বছর আমরা ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’র প্রথম বার্ষিকী পালিত করেছি—যেখানে আমাদের তরুণসমাজ স্বৈরাচারকে পরাভূত করে বৈষম্যহীন ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ নির্মাণ শুরু করেছে। সেই লক্ষ্যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমার ও আমার সহকর্মীদেরকে। ভেঙে পড়া রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল।”
তিনি বলেন, দ্রুত সিদ্ধান্তে নির্বাহী আদেশে সংস্কার করা সহজ পথ হলেও তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ বেছে নিয়েছেন। লক্ষ্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা — যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসক সৃষ্টি হবে না এবং কোন নির্বাচিত কৃতকর্মের ফলে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বরূপ ক্ষুণ্ন হবে না।
সরকারি সংস্কারের একটি বড় অংশ হিসেবে ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে বলেও জানান তিনি। এসব কমিশন জনমত যাচাই ও গভীর পর্যালোচনার ভিত্তিতে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। সেই সুপারিশগুলো টেকসইভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটকে নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের কাজ ছিল দলমত নির্বিশেষে সংস্কারগুলোর প্রতি একটি স্থায়ী সামাজিক অঙ্গীকার গড়ে তোলা — এবং এই অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগ সফল হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
ড. ইউনূস আরও জানান, ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সময়নিষ্ঠ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, যাতে আগামী নির্বাচনে যেই দলই জয়ী হোক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম উচ্চন্দর্তে স্থগিত না থাকে। তিনি বলেন, “সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না।”
মানবাধিকার ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়েও তিনি বেশ কিছু উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন—গত বছর জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারকে মাঠপর্যায়ের তদন্তে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তাদের সুপারিশগুলোকে জাতীয় সংস্কার কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া গুম সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে যোগদান ও নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রোটোকলে যোগ দেয়ার মতো আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রণয়ন ও স্বাধীন প্রতিরোধমূলক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরির কাজ চলছে বলে জানান তিনি। একই সাথে তিন বছর মেয়াদি একটি জাতিসংঘ মানবাধিকার মিশন পরিচালনার অনুমোদন দেয়ারও কথা উল্লেখ করেন, যা ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করেছে।
অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দুর্নীতির প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, “বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি — জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না।” দুর্নীতি ও সম্পদ লোপাটের ফলে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ায় তা মোকাবিলায় কঠিন কিন্তু প্রয়োজনীয় সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। তিনি বিশেষভাবে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার সংস্কারের উল্লেখ করে বলেন, নীতি-প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংস্থাকে পৃথক করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধি করবে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, পাচার হওয়া অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার করা সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার—গত ১৫ বছরে শত শত কোটি ডলার দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া ও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অর্থ ফেরত আনা কঠিন হয়ে পড়ছে; এসব দেশে যদি দৃড় সদিচ্ছা না থাকে তবে সফলতা সম্ভব হবে না। তিনি আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার, কর সহযোগিতা, অবৈধ আর্থিক প্রবাহ রোধ এবং পাচারকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধারে সমন্বিত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের জন্য আহ্বান জানান।
সংক্ষিপ্তভাবে তিনি বলেন, “আমরা চাই যে যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখছে তারা অপরাধের অংশীদার না হয়ে সেই সম্পদ প্রকৃত মালিক — কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের নিকট ফিরিয়ে দিক।” শেষ করে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কঠোর আন্তর্জাতিক বিধি-প্রণয়নের প্রস্তাবও উপস্থাপন করেন।
(সংবাদ সূত্র: প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণ।)









